ইউরোপের ককপিটে

  • by

ইউরোপের ককপিটে

 

এ অঞ্চলে হ্রদ, বাগান ও বনের অপূর্ব সম্মিলন, পাখির ডাক ও পাতার মর্মর-ধ্বনি আবিষ্ট করে রাখে রাত দশ টা পর্যন্ত, আর তখনই বেলাটি ডোবে, এর আগে নয়।

 

২০০৯ সালের ২৬ মে সারাদিন আবুধাবি বিমানবন্দরে ঘুরেফিরে খেয়েদেয়ে নাদুসনুদুস হয়ে পরদিন ব্রাসেলস বিমানবন্দরের  নেমেই একটা ধাক্কা খাই। ইমিগ্রেশন  কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, কোন উপলেক্ষে এসেছো? বলি বৈজ্ঞানিক সফরে, ল্যাবরেটরি ভিজিট।  তরুণ কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক জিজ্ঞেস করে, বলো তো ‘HACCP’ বলতে কি বোঝোয় ? উত্তর দেই, জানি না। তাহলে ল্যাব ভিজিটে কী করে এলে ?  আবার বলি, আমি বিজ্ঞানী নই, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে দলে অর্ন্তুভুক্ত হয়েছে, এমন আরো আছে।  সো আমার দিকে তাকিয়ে হাসি-কান্নার মাঝামাঝি অভিব্যাক্তি নিয়ে পাসপোর্ট এ ইমিগ্রেশনের সিলটা সেঁটে দেয়।  আমি ভেতরে ঢুকে কিছুটা অস্বস্তির অনুভুতি নিয়ে ড. মমতাজ দৌলাতানাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এর অর্থ Hzard, Analysis Critcal Control Point. বলি, আগে যে কেন  আমাকে পড়িয়ে আনলেন না।

 

বেলজিয়ামকে বলা হয় ইউরোপের ককপিট। কারণ বেলজিয়ামে যুদ্ধক্ষেত্রের  সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।  যেমন- Oudenarde, Ramilies, Fortenoy, Fleurus, Jemmapes, Ligny, Quarter Bar, Waterloo ইত্যাদি।  এক সময় বেলজিয়াম থেকে ইউরোপ এর যে কোন দেশে সহজে গমনাগমন সম্ভব ছিল।  তখন ফ্রান্স থেকে জার্মানি আক্রমণ এবং জার্মানি থেকে ফ্রান্স কিংবা স্পেন থেকে নেদারল্যান্ডস আক্রমণে বেলজিয়াম এর মাটি ব্যবহৃত হতো।  ১৮৩০ – ৩৯ খ্রিষ্টাব্দের বেলজিয়াম বিল্পব আরো দুটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। নেদারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ।  তিন প্রতিবেশি একত্রে মিলে হয় Benelux. তাই আগে ভাগেই ভেবে নেই ককপিটে বসে বেনেলাক্সের পুরোটাই ভ্রমণ করব কিংবা যাব ফ্রান্স  অথবা অন্য কোথাও।

 

বেলজিয়ামের Federal Agency for the Safety of the Food Chain- এর প্রতিনিধি মিস ওরিয়ে ক্রিস্টিন বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যার্থনা জানান।  এদিন বিকালে  ‘Grand Place’ দর্শনপূর্বক ব্রাসেলস শহরে একটা চক্কর দিয়ে চলে আসি হোটেল La Vignett এর  এটি উপশহর টারভুরেনে অবস্থিত।  এখনকার একটি জঙ্গলের ভেতর Food Chain এজেন্সির  ল্যাবটি স্থাপিত।  স্থানটি অতি চমৎকার। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা আমাকে অচ্ছন্ন করে রাখে: কাজল গভীর এ বন মধুর লাগে, কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকী আছে, যেতে হবে দূরে ঘমিয়ে পড়ার আগে।  কত দূর যাব জানি না, তবে ফ্রান্স আর নেদারল্যান্ডস তো অবশ্যই।  এই বন-জঙ্গলের মধ্যে হয়েছে আবার বৃষ্টি।  তাই সন্ধ্যায় সব ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। ভাগ্যিস একটা পাতলা সোয়েটারে এনেছিলাম। মে মাস বিধায় অন্যেরা কেউ কিছু নেয়নি। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা, আত্মীয় রফিকুল ইসলাম সস্ত্রীক চলে আসেন সাক্ষাৎ করতে।  জনালেন, গতকালই তাপমাত্রা উনত্রিশ ডিগ্রি ছিল, আজ হয়তো ছয়-সাত। বেলজিকরাই তাই বলে থাকে, আবহাওয়া আর আমাদের নারীর মন বোঝা ভার।  এবার রফিকের স্ত্রীকে একটু হাসতে দেখি।

 

পরদিন প্রতুষ্যে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে।  পাখ-পাখির  এতটা ডাকবে আগে ভাবিনি। এ অঞ্চলে হ্রদ, বাগান ও বনের অপূর্ব সম্মিলন, পাখির ডাক ও পাতার মর্মর ধ্বনি অবিষ্ট করে রাখে  রাত দশটা পর্যন্ত, আর তখনই বেলাটি ডোবে, এর আগে নয়। মেঘ কেটে দিয়ে রোদ উঠলে বেলজিকরা এখানে –সেখানে বসে আড্ডা দেয়, কিছুটা হৈ-হুল্লোর করে।  আজ উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হিসেবে পরিবদর্শন করি আফ্রিকান জাদুঘর। ভেতর ছাড়াও বাইরের পরিবেশ অতি চমৎকার।  এর চত্বরে রয়েছে কাষ্ঠনির্মিত অনেক হস্তমূর্তি। আর তাদের ইতিহাসের সাক্ষী বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর নির্দশন। ভেতরে প্রচুর অ্যানটিকের উপস্থিতি, যেন এক টুকরো আফ্রিকা।

 

বেলজিয়াম পুরো দেশটাই ইতিহাসের নানা ঘটনার  সাক্ষী। ইতিহাস এর বিভিন্ন পর্যায়ে  প্রচুর জাতিগত ও ভাষিক মিশ্রণ ঘটেছে। এখানকার ওলন্দাজ ভাষিকদের বলা হয় Flemish (Flanders), আবার ফরাসি ভাষীদের Walloons (Wallonia) ছেলেবেলায় প্রায়ই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতাম: পথিবীর সবচেয়ে  মজবুত ও মানসম্পন্ন কাচ কোন দেশে উৎপন্ন হয় ?  বলাবাহুল্য সেটি বেলজিয়াম।  এখন কাচের স্থান দখল করেছে চকোলেট।  তবে পুজিবাদী বিশ্বে বেলজিয়াম এর খ্যাতির অন্ত নেই। ইউরোপীয়  দেশগুলোর ঐক্যের অন্যতম নেতা এ দেশটি, যেখানে অবস্থিত ন্যাটোর সদর দপ্তর।  ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী এ বেলজিয়ামে ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও অবস্থিত। উল্লেখ্য, ইউরোপ ক’বছর  আগেই চালু করেছে তার নিজস্ব মুদ্রা  ইউরো, যা এখন বিশ্বের মুদ্রাবাজারের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। ইউরোপের এ সাফল্য বেলজিয়ামেরই জয়জয়কার ঘোষণা করছে।

 

তবে আমরা এখন সাফল্যের দিকে না তাকিয়ে আপাতত তাকাই ইতিহাসের দিকে।  স্থির হয় আগামী ত্রিশ মে যাব ওয়াটারলু। সকালে রফিকুল ইসলাম আসেন দূতাবাসের চালক দেলোয়ারকে  নিয়ে।  সঙ্গে তার নিজের  যানটিও। গিয়ে দেখি নেপোলিয়ানের যুদ্ধক্ষেত্র এখন ফসলের জমি,  তথায় নানা ফসলের চাষ হয়েছে। ট্যুরিস্ট বাসে মাঝেমধ্যেই ঘটনাকেন্দ্রিক বর্ণনা ও শব্দ বেজে উঠছে, যেমন:  অশ্বখুরধ্বনি, তলোয়ারের ঝনঝনানি ইত্যাদি। প্রথম ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ও সাত মিত্রশক্তির ( যুক্তরাজ্য, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া, এবং অন্যান্য) মধ্যে ওয়াটারলুর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৮১৫ খ্র্রিষ্টাব্দ এর ১৮ জুন।  সপ্ত-মিত্রের দুই অধিনায়ক ছিলেন Duke of Wellington   এবং General Von. ওয়াটারলু ছিল  একটি কৌশলগত স্থান, যেখান থেকে মিত্রশক্তির দ্বারা নেপোলিয়নের বেলজিয়ামে অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব ছিল। ওয়াটারলুতে  পাহাড়ের ওপর ফ্রান্সের  দিকে মুখ করে একটি সিংহমূর্তি স্থাপিত হয়েছে, নাম La Butte du Lion. ২২৬ টি সিঁড়ি অতিক্রম করে ওখানে উঠতে হয়।  অন্যান্য আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে ওয়েলিংটন জাদুঘর এবং সেন্ট যোসেফের রোমান ক্যাথলিক চার্চ, যেখানে ওয়েলিংটন যুদ্ধযাত্রার আগে প্রার্থনা করছিলেন।  এ স্থাপনায় ব্রিটিশ এবং ওলন্দাজদের স্মৃতিচিহ্নও দৃশ্যমান।

 

এবার আমাদের আস্তানা ব্রাসেলসের  হোটেল ব্লু ম দুপুরের পর বাঙ্গালি ভাইদের সহায়তায়ই রওনা দিই Atomium অভিমুখে।  এটোমিয়ামের স্থাপত্যশৈলী অপূর্ব।  Atomium ১০৩ মিটার  উচ্চাতার এক প্রতিকী কাঠামো, যা ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ব্রাসেলস বিশ্বমেলা উপলক্ষে স্থাপিত হয়।  স্থানটির নাম হিজেল।  স্থাপনাটির ডিজাইনার প্রকৌশলী মোজার্ট, আর স্থাপতিদ্বয় আঁন্দে ও জাঁ পোলাক। ভবনটির উচ্চতা ১০২ দুই মিটার।  এর ৯টি ১৮ মিটার (৫৯ ফুট) ব্যাসযুক্ত স্টেইনলেস স্টিলের গোলক এমনভাবে টিউব দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে যাতে প্রতিটি স্বচ্ছ গোলক এক বিলিয়ন গুণ বড় হয়ে প্রদর্শিত হতে পারে।  এতে এস্কেলেটর ও লিফট এর সংযোগ রয়েছে, যেন নয় গোলক এর পাঁচটি বিচরণযোগ্য গোলকে দর্শনার্থীরা আরোহণ করতে পারে।  এসবে আছে Expo hall,  প্রদর্শনী হল ইত্যাদি।  শীর্ষ গোলকটি থেকে পর্যটকরা পেতে পারেন ব্রাসেলস শহরের প্যানারোমিক ভিউ।  সিএনএন এটিকে ইউরোপ এর সবচেয়ে উদ্ভট ভবন বলে আখ্যায়িত করেছে।

 

এটোমিয়ামের পর চলে আসা হয় পাশের পুরনো রাজবাড়িতে। চালক দেলোয়ারের বদান্যতায় কেবল পুরনো নয়, নতুন রাজবাড়িও গমন সম্ভব হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর পরিদর্শন এর  জন্য বিজ্ঞান সচিব নাজমুল হুদা খান আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।  তাই প্রথম ইউরোপলই দেখতে হলো। দুটো ভবনই আলিশান এবং অতি চমৎকার।  ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদর দপ্তরের সামনে গিয়ে স্তম্ভিত হই। এত বড় কাচ-ভবন ? ব্রাসেলসকে বল হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী, যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে কোন রাজধানী ঘোষণা করেনি।  আমস্টারডাম চুক্তির মাধ্যমে আসলে ব্রাসেলসকে পার্লামেন্টের কাজ চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল মাত্র। মে মাস বিদায়, জুনে  দ্বিতীয় দিবসে উঠি লেপেলবেড হোটেলে। সেটি মিলে শহর।  সরাদিন ল্যাব সাদা অ্যাপ্রোন পরে কাটিয়ে  Gent শহরে যাওয়া হয়।  পুরনো এ শহরে একটা খাল বা নদী পেয়ে পুলকিত হই। কাছে কোথাও  বিমানবন্দর থাকায় শহরের আকাশজুরে পাই বিমানের ধোয়ার আঁকিঝুঁকি, নকশা, ও ধুম্র-ডিজাইন।  শুনেছি গেন্ট এর বিশ্ববিদ্যালয়টি বিখ্যাত। এখানে খাল নদীর পাশাপাশি দেখি ফুলগাছ, আর চারদিকেই রেস্টুরেন্ট এর ছড়াছড়ি।  Melle Leeuw স্টেশনে হয়ে আবার লেপেলবেডে ফিরে আসি। আমাদের কাঠের কক্ষে অনেক স্পেস, চারটি বেড, মানুষ মাত্র দুইজন, আমি আর মোখলেছ।

 

রাতে ল্যাব কর্তৃপক্ষ আমাদের  নৈশভোজে  আমন্ত্রণ জানায়।  হোটেলে গিয়ে পাশের হলরুমে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে পাই। তবে বিয়েটা হচ্ছে  দুই নারীতে। সমলিঙ্গের বিবাহ ওই সমাজে স্বীকৃত। প্রচুর লোক  সমাগম হয়েছে এবং ওরা নাচ-গানে একেবারেই মেতে উঠেছে। একটি নিগ্রো ও একটি শ্বেতাঙ্গ নারী। দুজনেই লম্বা, কালোজন মেয়ে পোষাক পরিহিতা, সাদাটি ছেলের মতো, কেবল বুক ঢাকা, তবে পিঠ উদাম। খেতে যুবক শাশার সঙ্গে আলাপ জমে উঠে।  সেও  একমত হয় এটা Lesbianism.  শাশা জানায়, নেদারল্যান্ডস এর আঞ্চলিক এবং  কিঞ্চিৎ অশ্লীল ভাষাটির নামই Flemish। তবে এটি নান্দনিক অশ্লিলতা।  উত্তম স্বাস্থের অধিকারী এ শাশাকে আমি নাম দিয়েছি ‘ বাঘের বাচ্চা’।   সে গতকাল বদলি হয়ে এ ল্যাবে যোগদান করেছে।  পরদিন বাড়ি ফেরার তাড়ায় প্রায় প্রত্যেকরেই ঘুম ভাংগে প্রত্যুষে।  খালি রাস্তায় বিশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে খবর পাই, আমরা মাছুমাকে ফেলে এসেছি। সে ঘাবড়ে যায় এবং কান্নাকাটি করে হোটেল-অফিসের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগে সক্ষম হয়।  একটা গাড়ি ফিরে যায় এবং  অতিরিক্ত অধাঘন্টা পর ওক বিমানবন্দরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এটি আসলে দলগত ব্যর্থতা, দলের মধ্যে এমনটি হওয়া কাঙ্খিত নয়।  তবে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত দায়িত্বও রয়েছে।

 

ইতিহাদ বিমানটি নড়েচড়ে দৌড় দিয়ে আকাশে উড়ল কত কথাই না মনে পড়ে!  মনে পড়ে আমস্টারডাম সিটি ট্যুর কীভাবে পরিদর্শন করেছিলাম ডায়মন্ড ফ্যাক্টরি, কোনো এক অজ্ঞাত রেলষ্টেশনে কীভাবে স্তম্ভিত হয়েছিলাম দেবশিশুর মতো সুন্দর শিশু দেখে। ওই খান থেকে ফিরতে কভিাবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ট্রেনটি মিস করে আধাঘন্টা পর অন্য ট্রেনে ব্রাসেলস ফিরেছিলাম।  স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল পরেরদিন কীভাবে প্যরিস মেতেছিল উন্মাদের মতো, পৃথিবীর কত শত ভাষার মানুষের  কথা শুনে ছিলাম আইফেল টাওয়ারের গোড়ায়।  তারপর লুভ মিউজিয়াম, মোনালিসার অদ্ভুত হাসি.. Thaly’s ট্রেনের ছাদে শিলাবৃষ্টি পতনের শব্দ..।  এবার ইউরোপে এসে এ স্বল্পকালীন প্রবাসেই অনেক আবেগের  জায়গা তৈরি হয়।  আমাদের এগিয়ে দিতে আসা মিস ক্রিস্টিন যতক্ষণ বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে আমাদের কাচের  ভেতর দিয়ে দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত দাড়িয়ে ছিল।  বিমানবন্দরে শেষ মূহুর্তের স্যুভেনির  কেনাকাটায় আকাতরে বিলেয়েছে ধাতব ইউরো-মুদ্রা। আমরা তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাই। ইউরোপ এমনও হয়।

 

বিচিত্র অভিজ্ঞতা

 

  • Wetteren স্টেশনে যেতে বাসে অপর এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ হয়। তাকে এক পর্যায় জিজ্ঞেস করি:  Vous puvez parler Francais ?  তিনি ধরে নেন আমি খুব ভাল ফরাসি জানি। (এক সময় জানতাম বটে)  এ ধারণা থেকে তিনি আমার সঙ্গে অনর্গল নিজস্ব স্টাইলে ফরাসি ভাষায় কথা বলে যান, যার মাথামুন্ড কিছুই বুঝিনি।  কেবল তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে গিয়েছি হ্যাঁ, না, অনেক ধন্যবাদ ইত্যাদি।  একথা  ল্যাবের  মিস মিক-কে জানালে তিনি খুব হাসাহাসি করেন। ( মিস মিকে পাতলা ও লম্বা যার বীপরীত মিস ক্রিস্টিন যে কি না আমাদের প্রটোকল দেন।)
  • বেলজিয়াম সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল উচ্চ। সেটি যথাযথ পেয়েছি, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলাম। যেমন- ব্রাসেলস শহরটি কিছুটা নোংরা। স্টেশনে অনেক ময়লা-আবর্জনা দেখেছি, এমনকি বিষ্ঠাও  দেখতে পাই। যেভাবে হাইরাইজ ভবনের  সামনে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে অনেক পলিথিন ভাসতে দেখি, তাতে আশ্চর্য না হয়ে পারি না।
  • ইউরোপ বর্তমানে কৃপণ হয়ে গেছে। এখন আর শপিং করলে বিনা পয়সায় উন্নমানের পলিব্যাগ দেয় না।  একদিন Carrefour শপে কেনাকাটা শেষে শপিং ব্যাগ চাইলে  দোকানি বলে তোমাকে দশ সেন্ট দিয়ে নিতে হবে।  পাশে দাড়ানো একটি বেলজিক তরুণী ফোড়ন কাটে, এখানে তুমি কোনো কিছুই বিনা পয়সায় পাবে না। কারণ এটা বেলজিয়াম।  তারপর উভয়েই সশব্দে হেসে উঠি।
  • বেলজিয়াম এর সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক মিল আছে।  এখানে অনেক খানাখন্দ, জলধারা দেখেছি। এসেবে বাংলাদেশের মতো অনেক বর্ষাকালীন জলজ উদ্ভিদ রয়েছে , যেমন – শাপলা, ও অন্যান্য।  বাতাসে সব সময় তুলোর মতো  কী যেন  ওরে। ‍  এগুলো হয়তো বায়ুদুষণ। শৌচাগারে প্রায়ই ময়লার স্তুপ দেখেছি।
  • এখানে বাস করে অনেক স্বল্পোন্নত দেশের মানুষ। মরোক্কানদের  বাঙালী নাম দিয়েছে খেজুর।  অনুন্নত দেশের মানুষ ওই খানে গিয়ে চুরি –চামারি করে দেশটাকে বিনষ্ট করেছে।  তাই বেলজিকরা সব সময় আমাদের ব্যাগ  ও মূল্যবান  দ্রব্য সাবধানে রাখতে বলে। একদিন গাড়ির সিটে ক্যামেরার  কভার রেখে কেবল ক্যামেরাটি নিতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন: এটিও নিয়ে নিন, কারণ  ওরা তো  আর জানবেনা যে কাভারটি খালি। কাজেই ওটা নিতে চোররা গাড়ির কাচ ভেঙ্গে ফেলবে।
  • ল্যাব ভিজিট এবং যে কোনো আলোচনায়  বসার আগে ওরা প্রায়ই  আমাদের academic discipline জানতে চেয়েছে।  বিসিএসআইআর এর বিজ্ঞানীরা বলেছেন কারো Chimistry কারো Molecular biology বা অন্য কিছু। বাকি তিন জন বলেছি Town Planning , Public Administration কিংবা আমাদের বিষয় শুনে ওরাহেসেছে, বিস্মিত হয়েছে।  এক পর্যায় ড. মমতাজ দৌলতানাকে বললাম, আপা পুনরায় কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব,  Molecular Public Administration শুনে সবাই হাসলেন। তারপর মাছুমা  বলল, খুব বেশি  বলবেন স্যার এবং সাকুল্যে একবারই বলবেন।  কারণ বিষয়টি কী, কারো কারো জনার আগ্রহ জন্মাতে পারে।  বেলজিয়ামে আমাদের বিস্ময়ের  অন্ত ছিল না তাদের  খাদ্য দ্রব্যের  মান নিয়ন্ত্রণ এর দক্ষতা ও সামর্থ্য দেখে।  ভেজাল দূরীকরণেও তারা সিদ্ধহস্ত, যা থেকে আমরা অনেক অনেক দূরে।