পাহাড়েরর পথে পথে

  • by

পাহাড়েরর পথে পথে

পাহাড়ের টানে চলুন ভারতের নানা জায়গায় । জেনে নিন পাহাড়ের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত।

তুঙ্গনাথ

চোপতাকে বলা হয় তুঙ্গনাথের গেটওয়ে। উচ্চতা ৩৮৮৬ মিটারের কাছাকাছি। দুরূহ চড়াই পথ তবে গুর্গম নয়। কংক্রিটের বাধানো, মসৃণ।  এ পথে চলার জন্যে ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকলেও চলবে। স্বচ্ছন্দে সপরিবারে যাওয়া যায়। হাঁটতে না পারলে ঘোড়া, ডান্ডি কিংবা কান্ডিতেও যেতে পারেন। পঞ্চকেদারের অন্যতম এবং হিন্দুদের পবিত্র শৈবতীর্থ এই তুঙ্গনাথ। উচ্চতায় কেদারনাথের থেকেও বেশি। শুধু তাই নয়, ভারতের সর্বোচ্চ মন্দির তুঙ্গানাথ। তুঙ্গনাথের পথে কেদারের মতো ভিড় নেই, নেই দূষণ।  হাতে গোনা অল্প পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন।  এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ চেয়ে দেখার মতো। মাথার উপর গাছের ছায়া, পাখির কাকলি আর বিচিত্রধর্মী ফুল- সব মিলেয়ে এক সুন্দর যাত্রা। কিছুটা এগোতেই সামনে পড়ে সবুজ ভেলভেটে মোড়া এক বিস্তৃত বুগিয়াল। দলে দলে ভেড়া চড়ছে সেখানে। উপত্যাকার একপাশে বেশ কিছু অস্থায়ী ঘরবাড়ি এবং দুটি চায়ের দোকানও আছে এখানে। বিশ্রামের জন্যে এর থেকে ভাল জায়গা আর কী হতে পারে! শীতকালটা এ সব জায়গা ঢেকে থাকে পুরু বরফের চাদরে।  ঘুরে দেখা যায় ভ্যালিটা।  কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আবার হাটতে শুরু করুন। যত সামনের দিকে যাবেন, পথ তত খাড়া। পথের বাঁদিকে রয়েছে বিপদজনক গভীর খাদ। এরকম এক বাঁকের মুখে একটা একটা দোকান পেয়ে আবার বসা। তৃষ্ণা নিবারণ করুন রডোডেনড্রনের নির্যাস থেকে তৈরি বিশেষ এক ধরনের পানীয় খেয়ে।  এটা নাকি বলবর্ধক এবং বেদনা নাশক। ‍তুঙ্গনাথ পৌছেতে মোট ঘন্টা দুয়েক লাগল। তুঙ্গনাথ ভ্যালিটা বেশ বড়।  মন্দিরের কিছুটা আগে থেকেই রাস্তার পাশে বেশ কিছু দোকান। মন্দিদেরর গঠনশৈলি কেদারনাথের মতো, তবে আয়তনে অনেক ছোট। পাশের পাহাড় বেয়ে তিনটি ঝরনা নামছে আকাশকুন্ডে।  আকাশগঙ্গা নদীর উৎস এই আকাশকুন্ড।  রাতে অসম্ভব ঠান্ডা পড়ে তুঙ্গনাথ। সে কারণে দিনের দিন তুঙ্গনাথ দর্শন করে চোপাতায় ফিরে আসাই ভাল।  আর যারা তুঙ্গনাথ থেকে চন্দশিলা যেতে চান, তাদের এখানে রাত্রিবাস আবশ্যক। কারণ চন্দ্রশিলালার প্রশস্তি সর্যোদয়ে।  তা ছাড়া গাড়োয়াল ও কুমায়ুন হিমালয়ের অসংখ্য নামীদামী পর্বতরাজি এখান থেকে সুন্দর দৃশ্যমান।

কীভাবে যাবেন:

বাংলাদেশ থেকে হাওড়া। হাওড়া থেকে ট্রেনে হরিদ্বার।  হরিদ্বার কিংবা হৃষীকেশ থকে বাসে উখিমঠ।  উখিমঠ থেকে বসে বা শেয়ার জিপে চোপতা।  চোপতা থেকে হাঁটা পথে কিংবা ঘোড়ায় তুঙ্গনাথ।

কোথায় থাকবেন:

চোপতায় থাকার জন্যে আছে হোটেল হিমালয়, রাজকমল, বুগিয়াল ছাড়াও  চটির হোটেল।  তুঙ্গনাথের থাকার জন্যে আছ হোটেল মোটেল তুঙ্গেশ্বর, চন্দ্রশিলা, নীলকন্ঠ, হিমালয় গণেশ এবং কালীকমলীর ধরমশালা ও মন্দির কমিটির রেস্ট হাউস।

কখন যাবেন:

মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তুঙ্গনাথ ভ্রমণের আদর্শ সময়।

রংপো

পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমের সীমান্ত শহর রংপো।  শহর লাগোয়া শান্ত, শুনশান পাহাড়ের কোলে সবুজ বনাঞ্চল।  এন জে পি স্টেশন থেকে  মিলবে গাড়ি। শিলিগুড়ি শহরঞ্চল পার হলেই সেবক। চারচাকা অনেক নীচে তিস্তার খরস্রোতা জলরাশিতে রবাবের ভেলায় দেখা যাবে র‌্যাফটিংয়ের জলছবি।  ৩১ নং জাতীয় সড়ক ধরে যেতে যেতে পেরিয়ে যাবে কালীঝোরা, তিস্তাবাজার।  এরপর মেল্লি। পাহাড়ি পথের ধারে দোকানপাট, বাড়িঘর নিয়ে জমজমাট এই ছোট জনপদ।  মেল্লি ছেড়ে খানিক এগুতেই রাস্তার বুকে তোরণদ্বার ।   পার হলেই রংপো শহর শহরে ঢোকার আগেই পাহাড়ি পথের দুপাশে শাল-সেগুনের সংরক্ষিত সবুজ বন।  রাস্তা জুড়ে রৌদ্রছায়ার খেলা।  প্রথম দর্শনেই মন জয় করে নেয় কংক্রিটের ছোট দোতলা অরণ্যনিবাসটি।  চত্বরে একফালি বাহারী বাগান।  দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের গয়ে সিকিমির ঘরবাড়ি। সবুজের আঙ্গিনায় বসে রৌদ্রস্নান করতে করতে উপভোগ করুন পাহাড়ে মেঘ – রৌদ্রের কত রঙ্গ।  বেরিয়ে পায়ে হেঁটে পাড়ি জমানো যায় পাহাড়িয়াদের বসতিতে।  যেতে যেতে সেই পথে সিঙ্কোনা, সেগুন, বাঁশঝাড় আর ঝাউয়ের শব্দ। দেখা হয়ে যায় আদা, এলাচে খেত।  গাড়ি নিয়ে এক দিনে যাওয়া যাওয়া যেতে পেরে মানসং, আলগাড়া –র-পথে। বিকেলে ঘোরাঘুরি করেত পারেন রংপো শহরে। খেতে পারেন অতি উপাদেয় গরমাগরম মোমো আর রসমালাই।

ঘুরে আসুন লেয়ার মার্তাম ওয়াটার গার্ডেন গ্যাংটকগামী পথের ধারে পাহাড়ি নদীর পাশে চমৎকার জায়গা। ভীতরে সিমেন্ট বাঁধানো  ছোট ছোট পদ্মপুকুর, মরশুমি ফুল, ফেয়ারি করা বাগান আর গাছপালায়  সাজানো। পাহাড়ি প্রকৃতিকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগের জন্যে পাতা রয়েছে কাঠের বেঞ্চ।  ক্যাফেটেরিয়াতে মিলবে চা, কফি, স্ন্যাকস। রাত্রিবাস করতে চাইলে সে ব্যবস্থাও আছে।

কী ভাবে যাবেন:

কলকাতা থেকে ট্রেনে এন জে  পি। স্টেশন চত্বর থেকেই পাওয়া যায় রংপো যাওয়ার প্রাইভেট গাড়ি।  পৌঁছে দেবে রংপো ফরেস্ট রেস্ট হাউসে।  বাসে ধর্মতলা থেকে মিলবে শিলিগুড়ির বাস। নামুন তেনিজিং নোরগে বাস টার্মিনালে।  গ্যাংটকগামী বাস বা জিপে আসুন।

কোথায় থাকবেন:

বনবাংলোতে থাকতে চাইলে যোগাযোগ করুন- পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগম, ৬এ, রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, কলকাতা -১৩। অথবা ডিভিশনাল ম্যানেজার কালিম্পং ডিভিশন, ডব্লু বিএফডিসি, কালিম্পং

কখন যাবেন:

মার্চ  থেকে জুন ও সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর।

বিন্দু

ডুয়ার্সের পর্যন্টন পকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বিন্দুর জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। ভারত-ভুটান সীমান্তে, জলঢাকা নদীর তীরে ভারতের শেষ গ্রাম বিন্দু। এর প্রাথমিক এবং ভৌলিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

দুর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে সিকিমের ঘরবাড়ি।

সবুজের আঙিনায় বসে রৌদ্রস্নান করতে করতে উপভোগ করুন পাহড়ে মেঘ-রৌদ্রের কত রঙ্গ।

বেরিয়ে পায়ে হাটে পাড়ি জমানো যায়।  পাহাড়িয়াদের বসতিতে।

যেতে সেই পথে সিমঙ্কোনা, সেগুন, বাঁশঝাড় আর ঝাউয়ের শব্দ।

দেখা হয়ে যায় আদা, এলাচের খেত বিকেলে ঘোরাঘুরি করতে পারেন রংপো শহরে।

ভারতের প্রথম জলবিদ্যুত কেন্দ্রে জলঢাকা হাইডেল প্রজেক্ট গড়ে ওঠে এখানেই।  চারপাশ পাহাড় ঘেরা, ছবির মতো সাজানো ঘরবাড়ি, গ্র্রামীণ হার্ট, অর্কিড আর ফুলের সমারোহ নিয়ে সারা বছরই সেজে থাকে বিন্দু।  এলাচ চাষের জন্যে বিন্দু বিখ্যাত ।  চা বাগানের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালই লাগবে।

শিলিগুরি থেকে মাত্র একশত চার কিমি দূরে বিন্দু।  যেহেতু সারাদিনে দুটি মাত্র বাস চলে এ পথে, তাই শিলিগুড়ি থেকে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে সব যেমন ঘুরে দেখা যায়, বেড়ানোর মজাটাও তেমন উপভোগ করা যায় ষোলো আনা। এই পথে হাটতেও ভাল লাগবে।  গ্রামের রাস্তা ধরে ট্রেকিংও করতে পারেন।  ট্রেকিং এবং হাইকিং করার জন্যে বিন্দু আদর্শ। মাহানন্দ রিজার্ভ ফসেস্টের বুক চিরে ৬৪ কিমি দূরের চালসা হয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে কুনিয়া মোড় থেকে পথ ঘুরে যাবে উত্তরে চাপামারির অরণ্যের ভিতরে।  দুপাশে দু’পাশে পর্ণমোচী বৃক্ষের ঘন অরণ্, মাঝখানে পিচঢালা মৃসণ পথ – এপথেই আরও চার কিমি এগোলে চাপরামারির তোরণদ্বার।  মাঝে ছোট ছোট জনবসতি।  চোখে পড়তে পারে হাতির দলের রাস্তা পেরনোর দৃশ্য।  পুরো জঙ্গলই নানা প্রজাতির পাখির দেখা মিলবে।  তাই বার্ড ও ওয়াচিং করতে চাইলে বিন্দু আসতে পারেন।  বিন্দু ড্যাম গৌরীবাস। গৌরীবাসের প্রসিদ্ধি ভেষজ উদ্ভিদ চাষ ও ওষুধ তৈরির  জন্যে। এখানে গাড়ি থামিয়ে ঘুরে দেখে নেওয়া যায় বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সিঙ্কোনার চাষ। গৌরিবাস রেখে কিছুদূর এগোতেই আর এক গ্রাম ঝালং।  গ্রামের বুক দিয়ে বয়ে চলেছে জলঢাকা নদী। নদীর  তীরেই গড়ে উঠছে জলঢাকা হাইডেল প্রজেক্টের উপনগরী। বিন্দু আর ঝালং এর মাঝে পড়বে আর পাহাড়ি গ্রাম প্যারেন। ঘুরে দেখা যেতে পারে গ্রামটি। মূলত জলঢাকা নদী আর প্রকৃতি নিয়েই বিন্দু। চারিদিকে যেন সবুজ গালিচা বিছানো।  ভুটান থেকে বিন্দু নদী এসে মিশেছে জলঢাকায়, সঙ্গমে বাঁধ দিয়ে গড়ে উঠেছে জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। কর্তপক্ষের  বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঘুরে দেখা যায়  প্রকল্পটি। লকগেটের সেতু পেরোলেই ওপারে ওপাশে র‌য়্যাল  ভুটান রাষ্ট্র। পারপারের কোন বিধিনিষেধ নেই। চমৎকার পাহাড়, অরণ্য, নদী কমলালেবুর বাগান সব মিলিয়ে বেড়ানোর অপরূপ জায়গা উত্তরবঙ্গের বিন্দু।

কী ভাবে যাবেন:

কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ির বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চালসা হয়ে জিপে বা রিজার্ভড গাড়িতে বিন্দু পৌছনো যায়।

থাকবেন:

বিন্দুতে বাজারের কাছে থাকার জন্যে আছে  শিবাজ ট্যুরিস্ট ইন, গাহুনবাড়ি দ্রুকিউল রিট্রিট প্রভৃতি বেশ কিছু হোটেল ও লজ।

কখন যাবেন: নভেম্বর থেকে মার্চ ।