পা বাড়ালে সবদিকেই বাংলাদেশ – বাংলাদেশ গন্তব্যস্থল

  • by

পা বাড়ালে সবদিকেই বাংলাদেশ ঃ – এখানে বাংলাদেশ গন্তব্যস্থল গুলো নিয়ে কাব্যিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

কুড়িগ্রামের সেই পাড়াগাঁর ভেতরে সমুদ্র আসবে কোথা থেকে? তিস্তা নদীও প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এমন শব্দ হচ্ছে যেন বনজঙ্গল ভেঙে বুনো হাতির পাল আসছে। একসময় তা এল বনের ওপর দিয়ে। খোলা ছাদে বাতাস, বিজলি আর বৃষ্টি শরীরের কোষে কোষে ঢুকে পড়ে এমন এক আনন্দ জাগাল, মনে হলো যেন আমিই বিজলি, আমিই বাতাস। আমিই আকুল হয়ে ঝরছি আমার ভেতর।

আরেকবার খুলনার পশুর নদে হঠাৎ আকাশ কালো করে বৃষ্টি এল। ছোট লঞ্চটা দুলছে; বৃষ্টির সাদা পর্দা ভেদ করে ১০ হাত দূরে দেখা যায় না। আর কোনো ঘটনা নেই। ঘণ্টা দেড়েক সেই নদে থাকা যেন এক আত্মা ধুয়ে দেওয়া সুখ। পাহাড়ের মতো মেঘরাশি, নদীর উথালপাতাল ঢেউগুলোর লাফ দিয়ে বৃষ্টিকে ছোঁয়া; এই দেখায় কোনো ক্লান্তি নেই। কিংবা কোনো সন্ধ্যায় বান্দরবানের এক পাহাড়ি নদীর পাশের রেস্ট হাউসে থামা। অমন সন্ধ্যা একা লোকের জন্য মন খারাপের, কেবলই নানান কথা মনে করার; তবু তাতেও আনন্দ আছে। ছাই ছাই অন্ধকারের রহস্যে ডুবে যাওয়ার রোমাঞ্চ আছে। পাহাড়ি নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হতে পারে, আহ্‌, নিজেকে মনে পড়ছে। শহরের ব্যতিব্যস্ততার মধ্যে যাকে হারিয়ে ফেলছিলেন, সেই আপনাকে মনে পড়ছে। নিজের আত্মাটার শুশ্রূষা করার দরকার আছে।

একটা ছবি হিজিবিজি, একটা ছবি টলটলে পরিষ্কার। কোনটা ভালো লাগবে আপনার? টিভির ছবির কথা হচ্ছে না। হচ্ছে মনের ছবির কথা। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরে বাস করে উৎকৃষ্ট ভাব অর্জন করা যায় না। ঢাকাবাসীর বেশির ভাগেরই মনের ছবিটা এ রকম হিজিবিজি। প্রতিদিনের ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ মনটাকে তাজা করতে প্রকৃতি ও মানুষে ভরিয়ে নিতে হয়। ভ্রমণ সেটা দেয়। দূরে গিয়ে ফিরে পাওয়া যায় নিজেকেই।

তাই মাঝেমধ্যে পলায়ন দরকার। বাঁচতে হলে পালাতে হবে। কোথায়? দেশগ্রাম, পাহাড়, অরণ্য, নদী-হাওর-বিল ও পথে-প্রান্তরে—যেদিকে দুচোখ যায়।

অনেকের কাছে বেড়াতে যাওয়া বিরাট আয়োজনের ব্যাপার। তাঁরা শহরে যা করেন, বেড়াতে গিয়েও ডুবে থাকেন তাতেই। যেতে হলে শহুরে ঠাটবাট অভ্যাস ফেলে যাওয়াই ভালো।

বাংলাদেশ কুয়াকাটা সৈকতে অবাক সূর্যোদয় দেখে এক বন্ধু বলে উঠল, ‘আহ্‌ কী সুন্দর!’ অপর বন্ধুটা সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিল। মোবাইল স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তার জিজ্ঞাসা, ‘কই কই?’

মেঘনার বিশালতা, পাহাড়ের গাম্ভীর্য, সৈকতের সূর্যোদয় কিংবা লাউয়াছড়া বনের পাখির ডাক যাকে দেখিয়ে-বুঝিয়ে দিতে হয়, সে চোখ থাকতেও অন্ধ, মন থাকতেও বিমনা।

পর্যটন এক আধুনিক শহুরে শৌখিনতা। কিন্তু বাংলাদেশের মেট্রোপলিটান নগরের মানুষের জন্য এটা অধিকার। এটা জীবনের প্রয়োজন। তাই সব শ্রেণির মানুষই এখন ঘোরাঘুরির মধ্যে আছে। গ্রামের লোক এখন আকছার বাসভাড়া করে বেড়াতে বের হয়। কেউ যতই স্বদেশের মানচিত্রের স্থানে স্থানে পা ফেলেন, দেশটা তাঁর কাছে ততই বড় ও আপন হতে থাকে। এটাও একধরনের আধুনিকতা। ভ্রমণশীল মানুষের মন উদার হয়। বৈচিত্র্যকে তাঁরা নিতে শেখেন।

আর এর পথ দেখাচ্ছেন আমাদের তরুণ-তরুণীরা। এবারের পর্যটন দিবসে আমাদের বাংলাদেশ পর্যটন দপ্তর অকপটে স্বীকার করেছে, দেশের তরুণেরা দেশের ভেতরেই অজস্র সম্ভাবনাময় পর্যটনস্পট চিনিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা যাচ্ছেন আর ফেসবুকে ছবি দিচ্ছেন। তা দেখে অন্যরাও যাচ্ছেন। এভাবে খুব নীরবে একটা পর্যটন বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে দেশময়। এ যেন দেশ আবিষ্কারের নেশা। যেখানেই পা ফেলো, সেখানেই তোমার বাংলাদেশ।

আর বাংলাদেশ এমনই, শত নষ্টের পরেও এখনো অনেক কিছুই আছে। যেকোনো মহাসড়ক থেকে যেকোনো গ্রামের পথে ঢুকলেই বিস্ময় জাগবেই। হয়তো পেয়ে যাবেন বিরাট দীঘির পাড়ে প্রাচীন বটের ছায়ায় লেখা প্রকৃতির ইতিহাস। বিরিশিরি নদী পেরিয়ে গোলাপি চীনামাটির পাহাড় দেখতে যাচ্ছেন। এমন বৃষ্টি এল, গহন এক বাঁশঝাড়ের মধ্যে থামলেন। সেই অন্ধকার বাঁশঝাড় আপনাকে নিয়ে যাবে দুনিয়ার বাইরের এমন এক নির্জনতায়, যেখানে সময় থমকে আছে। যেমনটা হয়তো বোধ হবে বরেন্দ্র এলাকার কোনো মসজিদ বা মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে। সময়হীনতার সেই বোধ দাম দিয়ে কেনা যায় না। দেশ দেখা আর অ্যামিউজমেন্ট পার্কে বেড়াতে যাওয়া এক নয়। সব আনন্দ হুল্লোড় করে হয় না, ট্যুর গাইডের লেজ ধরে পাওয়া যায় না। প্রকৃতির বিশালতা অথবা গ্রামীণ তুচ্ছতার মধ্যেও অগাধ আনন্দের সূত্র লুকানো আছে। একে আবিষ্কার করে নিতে হয়। কে করবে? আমি করব, তুমি করবে, সে করবে!

আর দেশময় ছড়ানো আছে গল্প। মুন্সিগঞ্জের চরে ডাকাতের গল্প, প্রাচীন কোনো জনপদে কেউ আপনাকে শোনাবে অদ্ভুত রূপকথা। কিংবা উপকূলের জেলেদের কাছে জানবেন হাঙরের সঙ্গে, ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করার গল্প। সেসব গল্প হার মানায় হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি কিংবা জ্যাক লন্ডনের সি উলফ উপন্যাসের দুঃসাহসী নাবিকের গল্পকে। কোনো গ্রামীণ মেলায় এমন গায়ক-গায়িকার দেখা পাবেন, যাঁর প্রতিভা আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে অনেক কাল। আমাদের লোকজ মেলাগুলোতে গ্রামীণ রঙ্গ-রসিকতার বিপুল উৎসব। যে জানে না, সে পায় না।

মানুষ নিজেরাই যখন অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে জাগিয়ে তুলছে, তখন সরকার কি দিতে পারে না একটু নিরাপত্তা? বাউফলে নদীতে বেড়াতে গিয়ে মা-মেয়ে ধর্ষিত হবেন কেন? কেন অচেনা জায়গায় ওত পেতে থাকবে বখাটে দুর্বৃত্তের দল। কিংবা জুটি দেখলেই নাক গলাতে আসবে পুলিশ? দেশটা সুন্দর হবে তখনই, যখন নিরাপত্তাটাও থাকবে, ভ্রমণশীল লোকের নিজস্বতাকে সম্মান করা হবে। এটা পর্যটন দপ্তরের ব্যাপার না, এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। এটা জাতীয়ভাবে উন্নত রুচি ও মানসিকতা অর্জনের ব্যাপার। আমাদের বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে বিদেশিদের স্বাগত জানিয়ে আসছে। আমরা এতে অভ্যস্ত। কিন্তু অল্প কিছু লোকের জন্য সমাজ সমতলে চলাচলে বাধা আসে। যা স্বতঃস্ফূর্ত তা-ই সুন্দর। পর্যটনকে স্বতঃস্ফূর্ত রাখতে ‘আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’ বললেই হবে না, দায়িত্বটা পালন করতে হবে।

এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নগরায়ণ হচ্ছে বাংলাদেশে। গ্রামদেশ কথাটাই প্রমাণ, দেশ মানেই গ্রাম। নগরদেশ কেউ বলে না। সেই দেশীয় গ্রামীণ আমেজটা বাঁচিয়ে, তার প্রকৃতির স্বভাবে বাধা না দিয়েও তো উন্নয়ন হতে পারে। কিন্তু মহাসমারোহে উল্টোযাত্রা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিরল প্রকৃতি ভরে উঠছে বাজারে বাজারে, ভবনে ভবনে। দেশের মুখ ঢেকে যাচ্ছে বিলবোর্ডে। চেনাজানা দেশটা হয়তো আর থাকবে না। সব নষ্ট হওয়ার আগেই একবার দেশটা দেখতে বের হোন, সন্তানকে দেখান, বন্ধুদের দেখান। দেশপ্রেম হাওয়া থেকে আসে না।

যতই দেশটার আনাচকানাচে থাকা জীবন ও রূপ দেখবেন, ততই একে আপন মনে হবে। দেশের মধ্যে দেশের মানুষের ভ্রমণ তাই নিছক পর্যটন নয়। তা দেশে ফেরার শিক্ষাসফরও বটে। পর্যটন কেবল পর্যটনকেন্দ্রের ব্যাপার না, শুধু স্থানকেন্দ্রিকও না। পর্যটন প্রকৃতি, মানুষ ও জীবনের মধ্যে প্রবেশের সদর দরজা। যেতে হলে তাই প্রকৃতির ভেতর দিয়ে যাও, মানুষের ভেতর দিয়ে যাও, সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে যাও, জীবন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। বাঁচতে হলে তাই মাঝেমধ্যে পালাও।

লেখকঃ ফারুক ওয়াসিফ