মনোরম মিরিক (Mirik)
ছোট অবকাশে জীবেনের মনোরম পরিবেশ পেতে চলে আসুন শৈলশহর মিরিকে।
ডুয়ার্সের তরাই অঞ্চল দিয়ে ট্রেন বা সড়ক পথে যেতে যেতে যখন কাছ নদী আগে তখন চোখের সামনে বিশাল উপত্যকা খুলে যায় হঠাৎ করে। সাদা নুড়ির বুক চিরে প্রাবাহিতা খড়স্রোতা নদীর পিছনে দেখা যায় জঙ্গল, তার ছিনে বলিষ্ঠ বাহাড়ের ভাঁজ। আর তারও পিছনে নীল আকেশের গায়ে কদাচিৎ উঁকি মারে দুধসাদা শিখরের চুড়া কয়েক মুহুর্ত। গাড়ি এগিয়ে যায়। দেখিয়ে যায় ঐশ্বর্যময়ী গিরিরাজেরনত্নখনির এক ঝলক। সেই রাজকোষের এক বহুমূল্য রত্নের মিরিক। তার সৌন্দর্য একটু ভিন্ন স্বাদের , যার সহজ উপমা হিমালয়ের বর্ণনায় সচরাচর মেলে না । দার্জিলিংয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে সিঙ্গলীলা পাহাড়ের বুকে ১৭৬৭ মিটার উঁচুতে ছোট্ট উপত্যকা এই মিরিক- অর্থ আগুনে শহর।
যাত্রা শুরু করুন শিলিগুড়ি থেকে মিরিকের পথে।
তিন ঘন্টার বৈচিত্রময় পথ। শহর ছেড়ে বেরতেই আরম্ভ হয়ে যাব হালকা পাহাড়ি ঢাল। সে ঢালে ঢল এনেছে চা-বাগানের সারি। শ্যাডো ট্রি দিয়ে ছাওয়া কচি সবুজ ও গাঢ় সবুজ চা-বাগিচার আঙ্গিনায় চলছে মঘ ও রৌদ্রের খেলা। প্রথমেই এল সুকনার বিশাল লাইফ স্যাংচুয়ারির অন্তর্গত।
এরপর গাড়ি পাহড়ি পথে উঠতে আরম্ভ করে। হিমালয়ের সৌন্দর্য এখানেই। ইউরোপ এ যে অ্যালপাইন বন ও বন্যপ্রাণীর স্বাদ পেতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়, হিমালয়ে মাত্র দু-এক ঘন্টার সেই বৈচিত্রময় প্রকৃতির আস্বাদ পাইয়ে দেয়। গাড়ি উঠতে আরম্ভ করলে মুহুর্তে পিছনে ফেলে দেয় তিস্তার উপত্যকাকে। দূর থেকে দূরান্তের চলে যায় তিস্তা, দেখা যায় একট চকচেকে রেখার আকারে । মাঝে মাঝে তাও বিলিন হয় উন্নতশির হিমালয়ের অতল গহ্বরে।
উচ্চতা বাড়তে থাকে। আর রাড়ে ঠান্ডা। শাল, সেগুন উধাও হয়ে দেখা দেয় বার্চ, পাইন। পেরিয়ে যায় পাহাড়ি অঞ্চলের বড় বসতি ফুগুড়ি এ পথে দেখা যায় প্রচুর কমলালেবুর গাছ। তারপর আসে লাবণ্যময়ী সৌরিনী। মিরিক থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরত্বের পাহাড়ি গ্রাম্য বসতি। ছবির মতো সাজানো তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে খাড়াই পাহাড়ের নয়নলোভা চা-বাগান। কোথাও কোথাও ঢালের মাঝ ইতস্তত গ্রাম্য ঘরবাড়ি, সে এক ভিন্ন সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। চার দিকে সৌরিনী টি এস্টেটের প্ল্যাকার্ড বাসানো।
চা-বাগিচা তো তরাইয়ের অল্প ঢালের ফসল।
অবশেষে মিরিক। স্বর্গদ্বারের এক বিস্ময়কর ধাপ্ দার্জিলিংয়ের ভিড় এড়িয়ে শৈলসৌন্দর্য আস্বাদনে ১৯৭৯ তে নতুন করে গড়ে ওঠে এই হিল স্টেশণ। মিরিকের মূল আকর্ষণ পাঁচ একরব্যাপী সমতলভূমী, আর তারই মাঝে প্রকৃতিদত্ত দীর্ঘ আঁকাবাকা মিরিক ঝিল বা সামেন্দু লেক। ঝাউগাছর ফাঁক গলে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতিফলন ঘটে ১.২৫ কিমি ব্যাপ্ত লেকের জলে। মাঝে মাঝেই নেমে আসে মেঘের ভেলা এই বিশাল ঝিলের ওপরে। ঢেকে ফেলে সম্পূর্ণভাবে। হিমালয়ের কোলে আরও অনেক ঝিল দেখেছি, তারা নির্জন প্রান্তে একাকিনী। ন্তিু মিরিক লেককে ঘেরে মানুষ সাজিয়েছে তার বিনোদনের পসরা। সেখান কেউ প্যাডল বোয়িং, স্পিড বোটিং করছে, তো কেউ গোড়ায় চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝিলের ধারে ধারে। লেকের পাড়ে মনোহর বাগচা। পাশে মাঠ । তার ধারে রেস্তরার সারি। কেউ সেখানে বসে খাচ্ছে আর লেকের শোভা দেখছে তো, কেউ জলের ধারে পাতা বেঞ্চিতে বসে অনমনা। ঝিলের পাড় ঘেঁষা ঝাউবনের ছায়ায় হাঁটার পথ আছে – এতদম বিদেশের ফরেস্ট ট্রেকগুলোর মাতো। চোখ তুলে চাইলেই চোখে পড়ে স্বর্ণতোরণে সাজানো এক বিশাল মনাস্ট্রি। যেন শৈলশিখরে স্বর্ণপুরী্ খাকড়াই পাহাড়ি পথের সিড়ি ভেঙ্গে উঠুন বৌদ্ধ মনাস্ট্রির ঝলমলে আঙ্গিনায়। অপরুপ সাজসজ্জার অলঙ্করণ। যোগ দিন প্রার্থনা সভায়। পরে মনাস্ট্রির অলিন্দ থেকে চেয়ে দেখুন নিচে, মিরিক ঝিলের দিকে ঝাউবনে ঘেরা হিমালয়ে-হ্রদের অনন্য দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
মিরিকের মনোরম আবহাওয়ায় সব সময়ই ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগবে। প্রায় বিশ হাজার লোকের বাস এখানে, গোরখাদের সংখ্যাই বেশি। দার্জিলিংয়ের কমলালেবুর সিংহভাগিই হচ্ছে এখানে।
মিরিক যাত্রীদের বড় আকর্ষণ এগার কিমি দূরের নেপালের পশুপতিনগর- বিদেশি পণ্যের সম্ভার নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন দোকানি। অবশ্যই এখান থেকে কিছু কিনে আনতে ভুলবেন না।
চেকলিস্ট
কীভাবে যাবেন।
কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ বাওয়ার যে কোনও ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি চলে যান। অথবা বিমানে যান কলকাতা থেকে বাগডোগরা। শিলিগুড়ি থেকে মিরিকের দূরত্ব ৫২ কিমি। নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে মিরিকের প্রচুর গাড়ি পাওয়া যায়। বুক করলে আসা যাওয়া এক হাজার টাকা মধ্যে পড়ে। না হলে জন প্রতি পঞ্চাশ থেকে আশি টাকা। দিনে দিন ঘুরে আসা যায়, আবার মিরিকে রাত্রিবাসও করা যায়।
কোথায় থাকবেন।
থাকার জন্যে মিরিক ঝিলক ঘিরে পচুর হোটেল, ডে সেন্টার ও লজ আছে।
কখন যাবেন।
বছরের যে কোনও সময় ঘুরতে যাওয়া যায়।
ট্যুর প্ল্যান
ঢাকা থেকে শিয়ালদহ থেকে রাতের দার্জিলিং মেলে উঠুন। সকালে পৌছে যান এনজিপিতে। এনজিপি বা শিলিগুড়ি থেকে মিরিক ঘন্টা তিনেকের পথ সেই দিন এবং পরের দুই দিন উপভোগ করুন মিরিকের সৌন্দর্য। মাঝে এক বেলার জন্য ঘুরে আসতে পারেন নেপালের পশুপতিনগর বাজার । ফিরুন একই ভাবে শিলিগুড়ি হয়ে কলকাতায় তারপর ঢাকায়। মোটমুটি পাঁচদিনের ছুটি নিলেই মিরিক ঘোরা সম্পূর্ণ।