জাফলং: বুলডোজারের শব্দ

  • by

জাফলং: বুলডোজারের শব্দ

সিলেট থেকে  জাফলং বাজারের দুরুত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। শহর থেকে ২১ কি. মি. দূরে পেট্রোবাংলার বিশাল কমপ্লেক্স, অর্থ্যাৎ হরিপুরের গ্যাস ফিল্ড। রাতে ফেরার পথে কূপ থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৭ কি. মি. দূরে সারীঘাট নামক এক স্থানে রয়েছে প্রাচীন এক পাণ্থশালা। প্রায় আড়াইশ বছর আগে জৈন্তা রাজা নির্মাণ করেছিলেন এই পান্থশালাটি। পাহাড়ের চূড়ায় পুরানো দালানটা অনেকটা এখনো আছে। তবে বড়ো বড়ো পাথরগুলো যা ক বছর আগেও দেখতে মানুষের ভীড় জমতো, সেগুলো আজ আর নেই।

একটু সামনে এগোলেই অর্থ্যাৎ ৪২ কি. মি. পথে জৈত্নেশ্বরী বাড়ী। এখানেই জৈন্তা রাজার রাজবাড়ী ছিল। রাজবাড়ীর প্রাচীরের গায়ে নানা বর্ণের চিত্র। রাজপ্রাসীদের সামনে স্বাধীন রাজার বিচার সভা বসতো বড়ো বড়ো পাথরের ওপর। বাড়ির আঙিনায় কুয়ার মতো বড়ো ঢাল ছিল্। কথিত আছে, এসব ঢালে রাজদ্রোহীদের নরবিল দেওয়া হতো।

তামাবিল সীমান্তের কাছে যতোই এগোনো যায় ততোই কালো পাহাড় আর সবুজের হাতছানি। মাঝে মধ্যে ঝরনার স্রোত। এতো ভাল লাগে যে, চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করে আমি পাহাড়টা ধরতে চাই। যদিও ঝরনা আর পাহাড় অনেক দূরে।

একটা ঝরনার সামনেই শ্রীপুর চা বাগান। পশ্চিম দিকে ব্যাক্তিমালাকানায় একটি পিকনিক স্পট। সবাইকে বারবার আসতে বলবে এর পরিবেশ আর পরিচ্ছন্নতা। পূর্ব দিকে যে পাহাড়টা আমাদের সীমান্তের ওপারে, ওটার পাদদেশে রয়েছে পাথর কোয়ারি আর চা বাগান। বাগানটা আছে খুবই অযত্নে। তবে পাথর কোয়াবিটা একটু দূর সীমান্তে। তামাবিল সীমান্তকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ক্লিয়ারিং ফরোয়াডিং ব্যবসা। বিভিন্ন ইমপোর্ট এক্সপোর্টের মালামাল ডাহুকী ভ্যালি ব্রিজ ক্রস করে বাংলাদেশ সীমান্তে আসে। সীমান্তের ওপারে আমাদের বিডিআর ওপারে বিএসএফ এর ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট। এই চেকপোষ্ট দিয়ে মেঘালয় থেকে পন্যসামগ্রী আসে। তবে কয়লাটা আসে বড়ো বড়ো ট্রাক লরিতে।

তামাবিলকে ডানে রেখে নতুন রাস্তা দিয়ে একেবেকে চলে আসা যায় জাফলং। খোয়াই নদীর তীরে জাফলং বাজার। ক বছর আগেও এতোটা বড়ো বানিজ্য কেন্দ্র মনে হয়নি একে। এতো জনবসতিও গড়ে ওঠেনি। বাঙালি শ্রমিকদের আনাগোনাও ছিল খুবই কম। নদীর ওপর জীবনধারণ করতে আসে পুঞ্জির খাসিয়া জনগোষ্টী। আর এখন ওদের কে দেখা যায় শুধু পান সুপারি, আনারস বিক্রি করতে। অনেকে পাহাড়ী জীবনধারনকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালি কালচারের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে। খোয়াই নদীর তীরে পাহাড়ের ব্যবসা এখন ভীষণ জমজমাট। স্থানীয় শ্রমিক বলতে তেমন কেউ নাই। কবছর আগেও খোয়াই নদীতে হাতে গোনা শখানেক নৌকা ছিল আর এখন প্রায় হাজার ছড়িয়ে গেছে। তার কারণ জাফলং এর খোয়াই নদীর বালি থেকে শুরু করে বড়ো বড়ে পাথর, এখানে ওখানে দেখা যায় বুল ডোজার। এখন সবটাই ব্যবসাভিত্তিক। বড়ো ব্যবসায়ীরা সাবকন্ট্রাক্টে শ্রমিকদের কাছ থেকে সিএফটি বা ঘনফুট হিসেবে পাথর কিনে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোয়াই নদীতে পাথর তোলা হয় বিভিন্ন পদ্ধতিতে। এবং ১০ বছরের বাবুলাল থেকে শুরু করে রংপুর থেকে আসা কছিমউদ্দিনও এখানে কাজের শ্রমিক। কাজ মানে শ্রম। ভীষণ কষ্টের শ্রম। ঠান্ডা পানিতে গা ভাসিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্য্ন্ত মাঝারি আকারের এক সি এফটি পাথর সংগ্রহ করতে পারলে মজুরি জোটে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এর মধ্যে দুবেলার খাবার। খাবার খেতে চলে যায় ২০ টাকা। হাতে থাকে ৫০। শ্রমের তুলনায় এ্ই ৫০ টাকা নেহাতই কমই। অথচ বড়ো বড়ো কন্ট্রাক্টররা পাথর বোঝাই ট্রাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ২৭ হাজার টাকা থেকে ৮০ হাজার টাকার পাথর। এসব পাথর আবার চড়া দামে সিলেট থেকে বার্জে করে ঢাকার গাবতলী ঘাটে কিংবা ফতুল্লা ঘাটে চলে আসে নদীপথে। চার পাঁচটা পাথর ভাঙার ক্রাসার মেশিন্ও এখানে চলে সারাদিন। বিকট আওয়াজের কারণে জাফলং অঞ্চলে কিংবা নদীতে নৌকা নিয়ে বেশিক্ষণ কেউ থাকতে পারে না। আবার ওদিকে সন্ধ্যার পর বিজিবি হুইসেল দিলে সব শ্রমজীবী মানুষকে সরে আসতে হয় সীমান্ত এলাকার পানি থেকে। তবে বর্ষার সময় কোথায় নোমন্স ওয়াটার তা বোঝা মুশকিল্ আর তাই বর্ষার সময়টাতে শ্রমিকরা কাজও করতে পারে না। কারণ প্রতিদিন পানি বাড়ে। পানি বাড়ালে ডুব দিয়ে পাথার তোলা সম্ভব নয়। এটা সম্ভব হয় শীতকালে।

তাই শীতকাল শ্রমজীবী মানুষের আনাগোনা বেশি। পর্যটকরাও আসেন। তবে পরিবেশ এখন অতোটা কাছে টানে না। পর্যটনের আমন্ত্রনে যে একবার যাবে, দুবার সে আর যেতে চাইবে না। কারণ জাফলং অঞ্চলে থাকার তেমন কোনো সুব্যবস্থা, হোটেল বা নিরাপত্তা কোনোটাই নেই। খোয়াই নদীর আর্কষণ এখন শ্রমজীবী মানুষের জীবনের আরেক মানচিত্র। আরেক জনপদ। প্রতিদিন ছেলে বউ স্বামী সবাই মিলেমিশে পাথর তোলে, তুলে ডিঙ্গি নৌকায় এপারে এনে জড়ো করে। আর সেখান থেকে নিয়ে যায় বড়ো ব্যবসায়ীরা। এসবের দিকে চোখ না ফিরিয়ে, দেখা যায় আরেকটি জিনিস। ওপারে খাসিয়া পুঞ্জি। খাসিয়া গ্রামে ঢুকলেই প্রচুর সুপারি গাছের সমাহার দেখা যাবে। গাছের সঙ্গে লেপ্টে আছে খাসিয়া বাগানের পান। ঝাল পান বলে বেশ সুনাম আছে এর। যদিও এখানে আর নীরবতা নেই। নেই ঘোরার মতো মনোরম পরিবেশ। তবু সুন্দর জাফলং এর দৃশ্যসকল দেখার মোহে এখনো শীতকালে হাজার হাজার মানুষ আসে এখানে।