রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগে পুষ্টি

  • by

রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগে পুষ্টি

ডাঃ মো মাজহারুল হক চৌধুরী

রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে অন্যতম ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতিবছর অসংখ্য লোক এ রোগ অকালে প্রাণ হারায়। বাংলাদেশ গত দশকে এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সঠিক পুষ্টি ও খাদ্য পরিকল্পনা এ রোগের বিভিন্ন জটিলতা দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।

রক্ত সংবহনতন্ত্রের বিভিন্ন প্রকার রোগকে সাধারণভাবে এক কথায় ‘হৃদরোগ’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ বিভিন্ন শ্রেণীর বিভিন্ন প্রকৃতির। প্রধানতঃ এ  রোগ দু প্রকৃতিরঃ কার্ডিয়াক বা হৃদপিন্ডের রোগ বা হৃদরোগ এবং ভাসকুলার বা রক্ত সংবহন নালীর রোগ।

হৃদপিন্ডের রোগে আকস্মিকভাবে  কেউ আক্রান্ত হতে পারে। ধীরে ধীরে হৃদপিন্ডের কর্মক্ষমতা হারিয়ে এ রোগের সৃষ্টি হতে পারে।

রক্ত সংবহন নালীর রোগে ধীরে ধীরে ধমনীর ভিতরের আবরণে চর্বি কোলেষ্টেরল আকারে জমা হয়ে রক্ত সঞ্চালন পথ সরু হয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে ধমনীর স্থিতি স্থাপকতাপ নষ্ট হয়ে যায়। ধমনীর রক্ত সঞ্চালন পথ সরু হয়ে যাওয়ার ফলে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। এ অবস্থাকে বলা হয়। এর ফলে রক্তের অভ্যন্তরীন চাপ বৃদ্ধি পায়। যাকে উচ্চরক্তচাপ বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় হৃদপিন্ডের ধমণীতে চর্বি জমা হয়ে নালিকা অত্যাধিক মাত্রার সরু হয়ে হৃদপিন্ডের মাংসে রক্ত সরবারহ ব্যহত হয় অথবা এই অত্যাধিক সরু ধমনীতে নালিকার অন্য কোন জায়গায় ফ্যাটপ্লেক ছুটে এসে এই পথ বন্ধ করে হৃদপিন্ডের মাংসে রক্ত চলাচল হঠাৎ ব্যাহত করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আকস্মিকভাবে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।

এ সকল রোগগুলি পরস্পর নিবিড় সর্ম্পকযুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্তে চর্বির মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিই এইসব রোগে মুখ্য ভুমিকা পালন করে। এই চর্বি ই কোলোস্টেরলের আকারে বিভিন্ন ধমনীর নালিকা গহ্বরে ধীরে ধীরে জমা হয়। এ কারনেই রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়র ফলে হৃদপিন্ডের উপর অত্যাধিক চাপ পড়ে। অনেক সময় হৃদপিন্ডের অভ্যন্তরস্থিত কপাটিকা অকেজো হয়ে যায়। এতে করে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়ে হৃদপিন্ডের কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, তা ছাড়া রক্তের এই উচ্চচাপের ফলে ধমনী কাঠিন্য এর মত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। যার ভিতরে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

হৃদরোগে খাদ্যনীতি

বিভিন্ন হৃদরোগে খাদ্য পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা একান্ত অপরিহার্য। হৃদরোগের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং অবস্থা বিবেচনা করে খাদ্য নির্বাচন করতে হয়। সাধারণতঃ হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পুস্টির বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পুষি।টর যোগন আবশ্যক। যেহেতু হৃদপিন্ডের কাজ গ্লুকোজ প্রয়োজন হয়, সে জন্যেই শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যই বেশি ব্যবহার করা উচিত। আমিষ এবং চর্বিজাতীয় খাদ্য অনেক সময় হৃদপিন্ডের কাজ অপ্রয়োজনীয় মাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এসব খাদ্য শরীরের প্রয়োজনের মাত্রায় বজায় রাখতে হবে।

স্বভাবতঃ হৃদরোগীরা মেদস্থল প্রকৃতির হয়। এদের কম খাদ্যশক্তিযুক্ত খাবার দিয়ে শরীরের ওজন স্বাভাবিক বা কিছুাটা কম রাখা আবশ্যক। রোগীর গুরুতর অবস্থায় বেশি খাদ্যশক্তি সমৃদ্ধ তরল খাবার দেয়া যেতে পারে। যে সব খাদ্য রোগী পছন্দ করে না সে গুলো এড়িয়ে খাদ্য নির্বাচন করতে হবে। শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যের ভিতর এমন খাদ্য দেয়া ঠিক নয় যেগুলি পরিমাণে অত্যাধিক বা পেটে গ্যাস সৃষ্টি করতে পারে। (মুড়ি, চিড়া) ইত্যাদি। এতে রোগীর হৃদপিন্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে।

প্রতিদিন

হৃদরোগীদের প্রচুর পরিমাণ শাক সবজি গ্রহণ করা উচিত। গবেষণায় দেখা গেছে, শাক সবজি আঁশ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিতে পারে। রোগীর শারীরিক অবস্থাভেদে নিয়মিত ব্যায়াম করা একান্ত আবশ্যক।  এতে শরীর ও মন দুইই ভাল থাকে। এ ব্যায়ামের ফলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, সোডিয়াম বিশোষণ  কম হয় ও রক্তের ইনসুলিন মাত্রা কমে গিয়ে রক্তচাপ কমাতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদী ‍হৃদপিন্ডের রোগে খাদ্য

এই রোগ কার্যক্রম বা কার্যে অক্ষম শ্রেণীর হতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে হৃদপিন্ডে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখতে পারে। কিন্তু কার্যে অক্ষম অবস্থায় হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়ে যায়।

এসব ক্ষেত্রে রোগীদের স্বাভাবিক ওজন অপেক্ষা শতকরা ১০ ভাগ কম ওজনসম্পন্ন হওয়া উচিত। যদি রোগীরা বেশী ওজনসম্পন্ন হয় তবে কম খাদ্যশক্তিযুক্ত খাদ্য নির্বাচন করতে হবে। যদি রোগীর শরীর বিশেষ করে পায়ে পানি আসে তবে লবণ খাওয়া পর্যায়ক্রমিকভাবে কম হওয়া একান্ত বাঞ্চনীয়। খাদ্যে খাদ্যপ্রাণ এবং খনিজ লবণের অন্য সবগুলি যথাযথ পরিমাণ থাকা আবশ্যক।

যেহেতু এ রোগ হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক কাজকর্মের অভাবে শরীরে সোডিয়াম এবং পরবর্তী পানি শরীরে জমা হয়ে শোথ হয়, সে জন্য যে সব খাদ্যে সোডিয়াম কম আছে সে সব খাবার গ্রহণ করতে হয়।

আকশ্মিক হৃদপিন্ডের রোগে খাদ্য

এ রোগ কোন কোন গুরুতর সংক্রমনের ফলে আকস্মিকভাবে হয়ে থাকে। রোগে রোগী অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু চিবিয়ে খেতে পারে না। মুখ দিয়ে নিতে হয় তাই খাবার সব সময় অতি নরম বা তরল হতে হয়। রোগীর কম করে ঘন ঘন খাবার গ্রহণ করা উচিত। উত্তেজক হিসাবে চা, কফি, কোকা, ইত্যাদি খাবার খাওয়া উচিত নয়। তাড়াহুড়া করে খেতে যাওয়া মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। মনে রাখা দরকার এসব রোগে খাদ্যে দৈনিক পুষ্টি প্রয়োজনের সর্বনিম্ন মাত্রা বজায় রাখতে হয়। শ্বেতসারসমৃদ্ধ খাদ্যেই এক্ষেত্রে যথোপযুক্ত। কারণ চর্বি বা আমিষবহুল খাদ্য এই সময় হৃদপিন্ডের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

       রক্তসংবহননালীর রোগে খাদ্য

‘আগেই বলা হয়েছে যে খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে চর্বি বা মেদ জমা হয়ে রক্তসংবহন নালীর রোগ সৃষ্টি হয়। আমরা সাধারণত চর্বিযুক্ত খাবার থেকে  এই কোলেষ্টরণ গ্রহণ করে থাকি। তাছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যশক্তিযুক্ত খাবার গ্রহণ করলেও শরীরকে মেদ জমা হয় যা ধমনীর অভ্যন্তরে কোলেস্টেরল জমতে সহায়তা করে। অনেক সময় বংশগতভাবেও অনেকের এই কোলেস্টেরল দ্রুত জমা হতে দেখা যায়। বয়স এবং যৌন (সেক্স) হরমোনের সঙ্গে এ রোগের একটা নিবিড় সংযোগ আছে। ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মেয়েদের হৃদরোগ তুলনামুলকভাবে পুরুষদের চেয়ে অনেক কম। অর্থ্যাৎ পুরুষদের যৌন হরমোনে এ রোগকে যেমন বাড়িয়ে দেয় তেমনি মেয়েদের যৌন হরমোন এ রোগের ঝুঁকিও অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। সম্প্রতি অষ্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক জানিয়েছেন যে, নিয়মিত মাছ খাওয়া  হৃদরোগের ঝুকি কমিয়ে আনতে পারে। কমনওয়েলথ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা সংস্থার মানব পুষ্টির উপর একটি গবেষক দল  (সিএস আই আর ও) তাদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখিয়েছেন যে, মাছের তেল হৃদযন্ত্রের পেশীকোষ এমনভাবে পরিবর্তন করে ফেলে যে এতে হৃদরোগের ঝুকি কমে আসে। তবে গবেষকরা সর্তক করে বলেছেন, মাছের দেহের মাংসল অংশের তেলেই উপকারী অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নয় এবং  এ কারণে নিয়মিত কড মাছের তেল খাওয়া দেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ডিম এবং মাংসে প্রচুর কোলেস্টরল রয়েছ। তাই এসব রোগীদের প্রাণীজ আমিষের জন্য মাছের উপর নির্ভ করা উচিত। নেব্রাংক লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মায়ুচি পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে, রসুন রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিতে সক্ষম। যে সব মেদবহুল লোকেরা খাওয়ার সাথে বেশি সোডিয়াম বা লবণ গ্রহণ করে থাকে তাদের পরবর্তীতে হৃদরোগ সৃষ্টি হতে পারে।

প্রতিদিনি আমরা গড় ২৬০০ – ৬০০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সোডিয়াম গ্রহণ করে থাকি। আমরা খাবার লবণ হিসেবে যা ব্যবহার করি তার শতকরা ৪০ ভাগ সোডিয়াম। গবেষণার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, যেসব লোকদের বংশগতভাবে উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিত অর্থ্যাৎ গড়ে প্রায় ১ গ্রাম লবণ দৈনিক গ্রহণ করার প্রয়োজন হলেও স্বাভাবিক খাদ্যে ১০ তেকে ১৫ গ্রাম সোডিয়াম থাকে। তা ছাড়া জনশ্রুতি রয়েছে যে লবণ সামান্য তাপ দিয়ে খেলে কোন ক্ষতি হয় না। এটা অবৈজ্ঞানিক এবং অবৈধ ভুল ধারণা। সোডিয়াম ছাড়া অন্যান্য খনিজ লবণ যেমন লৌহ, আয়োডিন ইত্যাদি সঠিক মাত্রায় গ্রহণ করা আবশ্যক। খাদ্যপ্রাণও প্রয়োজনানুসারে গ্রহণ করতে হবে। এ রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যে সোডিয়ামের পরিমাণ কম বেশি করা যেতে পারে। এ জন্য তিন ধরনের সোডিয়াম পরিকল্পিত খাদ্যের পরামর্শ দেয়া হয়ঃ

১) মৃদু সোডিয়াম পরিকল্পিত খাদ্যে সোডিয়ামের পরিমাণ ২৪০০ থেকে ৪৫০০ মিলিগ্রাম থাকতে পারে।

২) মধ্যম শ্রেণীর খাদ্যে ১০০০ মিলিগ্রাম থাকতে পারে এবং ৩) সর্বশেষ রকম খাদ্যে সোডিয়ামের পরিমাণ ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়।

নিম্নে কম সোডিয়াম পরিকল্পিত খাদ্যের একটা নমুনা দেখানো হলো। প্রস্তাবিত খাদ্যে সোডিয়াম ৪৮০ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি ১৭০০ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে অন্যান্য খাদ্যপ্রাণ ও খনিজ লবণ যথোপযুক্ত মাত্রায় রাখা হয়েছে।

অধিকাংম হৃদরোগ (বিশেষ করে উচ্চরক্তচাপ) আজীবনের রোগ। এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে হয়। অতএব এসব রোগ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করে রোগী নিজের যত্ন নিজে নিতে পারেন ও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। এ বিষয়ে ডাক্তারদের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে রোগীকে রোগের জটিলতা সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়া এবং রোগীর নীতিমালা মেনে চলার জন্য উপদেশ দেয়া উচিত। রোগীরাও সবসময় হাসিখুশি থাকা, উত্তেজিত না হওয়া এবং ধুমপান, সুরাপান বর্জ করে ডাক্তারী পরামর্শ মত চলা ও সময়মত ডাক্তারী পরীক্ষা করানো উচিত।

 

বিশেষ প্রয়োজনেঃ 

আপনার যে কোন সময় এম্বুলেন্স সার্ভিস দরকার হতে পারে। যে কোন ধরনের এম্বুলেন্স সার্ভিস পেতে হলে খালেদ এম্বুলেন্স সার্ভিস এ যোগাযোগ করুন। অথবা কল করুন এখনই ০১৯৩৩২৪৬৫৭৭ – এই নাম্বারটি মনে রাখুন অথবা আপনার মোবাইল এ সেভ করুন এখনই। kmosarrof@gmail.com

আমাদের এম্বুলেন্স সার্ভিস ভিজিট করুনঃ https://khaledrentacar.com/ambulance-service/