সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর নানান দুর্ভোগ

  • by

সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর নানান দুর্ভোগ

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট, শিক্ষিতে হার এক শতাংশেরও কম

আবদুল কুদ্দুস রানা

দেশের দক্ষিণ সীমান্তে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার একটি ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন। সদর টেকনাফ থেকে প্রায় ৩০ কি, মি. দূরে ৩ দশমিক ৩৭ বর্গ কি. মি. আয়তনের এই দ্বীপের লোকসংখ্যা 6 হাজার। পেশা ৫ % কৃষি, ৯৫% মাছ শিকার।  দ্বীপের প্রধান সমস্যা ভেড়িবাধ। যাতায়াতের উন্নত ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষায় ছয় মাস এ দ্বীপ মুল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। শিক্ষা ও স্থাস্থ্য সমস্যা প্রকট। দ্বীপের শিক্ষার হার শতাংশেরও কম। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে নারকেল, পেঁয়াজ অন্যতম। এছাড়া রয়েছে বিপুল মৎস্যসম্পদ।

স্টিমার সার্ভিস দীর্ঘ দিনও চালু হয়নি

সমুদ্রপথে যাতায়াত সমস্যা দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের। সদর টেকনাফ থেকে ৩০ কি. মি. দূরে সেন্টমার্টিনে যেতে ছোট ছোট যান্ত্রিক নৌযান নিয়ে প্রথম নাফ নদী এবং পরে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে হয়। বর্ষায় সমুদ্র যখন উত্তাল থাকে তখন প্রায়্ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে থাকে। অথচ দ্বীপবাসী দীর্ঘদিন ধরে  জানিয়ে আসছে এ পথে স্টিমার সার্ভিস চালুর জন্য। সেন্টামার্টিন দ্বীপে পা পড়েনি এমন কোন রাষ্টপ্রতি, প্রধানমন্ত্রি, উর্দ্ধতন কর্মকর্তা দেশে নাই বলে গর্ব করে  বলে থাকেন দ্বীপের লোকজন। তারা প্রত্যেকেই দ্বীপের উন্নয়নের কথা বলে যান। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেন্টমার্টিন থেকেই আশ্রায়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরন করতে এ পথে স্টীমার সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন। অন্যদিকে দ্রুত কিংবা জরুরী সংবাদ আদান প্রদানে এ দ্বীপে কোন সুষ্টু ব্যবস্থা নেই। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি ওয়ারলেস সেট কিছুটা হলেও মানুষের উপকারে আসছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃত খবর নেয়া যায় দু তিন দিন পর। টি এন্ডটির আওতাধীন ভিএইএফ এর একটি স্টেশন স্থাপিত হলেও দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তা অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

হাসপাতাল স্থাপনের আশ্বাস

দ্বীপের স্থাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার হাল করুন। একটি স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র থাকলেও ডাক্তারের অনুপস্থিতির কারনে এটি জনগনের কোনো উপকারে আসে না। লোকজনকে বহু কষ্টে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফ হাসপাতালে আসতে হয়। অর্থাভাবে যারা টেকনাফে যেতে পারে না দ্বীপেই তাদের মৃত্যুবরণ করতে হয়।  সমুদ্র দ্বীপে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে দুজন গ্রাম্য ডাক্তার। ওষুধের দোকান রয়েছে দুটি। তিনগুন দামে বিক্রি হয় ওষুধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেন্টমার্টিন এসে চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১০ শয্যার একটি হাসপাতাল স্থাপনের আশ্বাস দেন। এরপর কিছু তৎপরতা দেখা গেলেও এখন তা বন্ধ। হাসপাতালের জন্য এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।

শিক্ষার হার যেখানে এক শতাংশের কম

দ্বীপের ৬ হাজার অধিবাসীর মধ্যে স্নাতক পাস করেছেন একজন। তিনি বর্তমানে ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার সামসুল ইসলাম। এক সময় তিনি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এইচ এস সি পাস একজন ও এস এস সি পাস আছে তিনজন। শিক্ষিতের হার এক শতাংশের কম। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বলতে একটি হাই স্কুল। আরো রয়েছে একটি সরকারি, দুটি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা ও পাঁচটি মক্তব।

বয়স্ক ভাতা থেকে বঞ্চিত দ্বীপবাসী

বর্তমান সরকার সারাদেশে ৫৭ বয়সোর্ধ্ধদের জন্য ১০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা চালু করলেও সেন্টমার্টিনবাসী এখনো তা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এই দ্বীপের ৯০ জনের তালিকা নির্ণয় করা হয় মার্চ মাসে। শুধুমাত্র ছবির অভাবে তাদেরকে বয়স্ক ভাতা প্রদান করা যাচ্ছে না। এলাকার বয়স্করা ৩০ মাইল দুরে এসে ছবি তোলার প্রয়োজন অনুভব করেছেন না। অনেকের আর্থিক সমস্যা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ছবি তোলার উদ্যোগ নিচ্চিত না। ইতিমধ্যে তালিকাভূক্ত বয়স্কদের কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বয়স্ক ভাতা তাদের ভাগ্যেও জোটে না।

সাইক্লোনের সংকেতে আতঙ্কিত দ্বীপবাসী

ঘূর্ণিঝড় কিংবা সাইক্লোনের সংকেত শুনলেই দ্বীপবাসীর মাঝে নেমে আসে আতঙ্ক। দ্বীপের চতুর্দিকে ভেড়িবাধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড় দ্বীপটি প্লাবিত হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ১৯৯৪ সালের ২ মে  এবং ১৯৯৬-৯৭ সালের কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি প্লাবিত হয়। দ্বীপের তিনটি মাত্র ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজনরে তুলনায় পর্যাপ্ত নয়।  দ্বীপবাসী চতুর্দিকে পাথরের বাধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

প্রধান পেশা মৎস্য শিকার

দ্বীপের ৯৫ শতাংশ লোকের প্রধান পেশা মৎস্য শিকার। বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরে আট মাস সাগরে নামতে পারে। বাকি সময় বেকার থাকে। কারন এই সময় সাগর উত্তাল থাকে। সাগরে জলদস্যূদের উৎপাত, মায়ানমারের নাসাকা বাহিনিীর সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে বহু জেলে নৌকা, জাল, মাছ হারিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে বহু জেলে। অথচ এখানে নেই কোনো মৎস্যজাত প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র। দ্বীপে ওঠানামার জন্য নেই কোন জেটি। ফলে জেলেরা ন্যায্যমূল্যে মাছ বিক্রি ও সংরক্ষণ করতে পারে না।

শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের জন্য

প্রাকৃতিক সৌন্দ ছাড়াও উদ্ভিদ, প্রাণী ও ভূগোল বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সেন্টমার্টিন শিক্ষা সফরের জন্য আর্কষণীয়। এখানে দূর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং হাঙ্গর দেখা যায়। জীববিজ্ঞানের ছাত্রদের কৌতূহল মেটাতে তারামাছ, লবস্টার, চিংড়ি, রাজকাকরা, কচ্ছপ, কালামুনাইস, সিপিয়া, মুলস্কাসহ ১০৩ প্রজাতির মাছ এখানে সহজলভ্য।

দ্বীপের চেয়ারম্যান যা বলেন

দ্বীপের চেয়ারম্যান মাস্টার সামসুল ইসলাম জানান দ্বীপের নানা সমস্যার কথা। দ্বীপের চারদিকে পাথরের বাঁধ নির্মাণ, সমুদ্রপথে স্টীমার সার্ভিস চালু, দ্বীপে ওঠানামার জন্য জেটি নির্মাণেল দাবি জানান। তিনি জানান, সেন্টমার্টিনকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হলে হাজার হাজার পর্যটক দিনে এসেই ফিরে যেতো না। পর্যটকদের জন্যে এখানে থাকা খাওয়ার উন্নত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। চেয়্যারম্যান আরো জানান, শিক্ষার হার বাড়াতে এখানে আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে আরো আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ এবং পানীয় জল সমস্যা নিরসনে দ্বীপে প্রচুর নলকূপ স্থাপন জরুরী। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ হাল বর্ণনা করে তিনি বলেন, কোনো ডাক্তারই এখানে থাকতে চায় না। ফলে লোকজনের দুর্ভোগ বাড়ে। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর বহু লোকের মৃত্যু হয়।

সীমান্তবর্তী দ্বীপ বিধায় সেন্টমার্টিন সামরিক স্থাপনার দিক দিয়েও যথেষ্ট গুরুত্বর্পূন। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে সেন্টমার্টিন বাসী তাদের দূর্ভোগের অবসান চায়, পাশাপাশি সরকারও এখানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করে পেতে পারে বিপুল পরিমান রাজস্ব।