বিজয় দিবস – স্মৃতির পথে হাঁটা

  • by

 বিজয় দিবস – স্মৃতির পথে হাঁটা

নজরুল ইসলাম

আর পাঁচদিন পর ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবস। প্রতি বছর দেখা যায় বিজয় দিবসে শহরের রাস্তায় রাস্তায় অসংখ্য মানুষকে বিজয় মিছিলে, সমাবেশ। বাবা কিংবা মায়ের হাত ধরে ছোটরা, বন্ধুরা এক সঙ্গে দল বেধে। অযথা পরিবারের সবাই মিলে ঘুরছেন সারাদিন। দেখছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলো। নকশার পাঠকদের জন্য চলুন ঘুরে আসা যাক এই শহরে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হয়ে থাকা ভাষ্কর্য, স্থান কিংবা যাদুঘর থেকে।

৬ ডিসেম্বর সকাল। ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল ৭১ এর ঠিক এই দিনেই বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশে হিসেবে  প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি দেশ হিসেবে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি পেয়েছিল। আর এদিনেই নকশার এসাইনমেন্ট নিয়ে দেখা হলো ঢাকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় স্মারকগুলো। গাবতলী টার্মিনাল থেকে বাসে উঠলাম। বন্ধু বাতেনের সৌজন্যে পূর্বাশা হাই চয়েস কোচে করে পৌছে গেলাম সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধে। গাবতলী থেকে ২০/৩০ টাকা দিলে লোকাল বাসগুলো নবীনগর বাস স্টপেজে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে একটু এগিয়ে গেলেই স্মৃতিসৌধ। বিজয় দিবস উপলক্ষে ধোয়ামোছার কাজ চলছে স্মৃতিসৌধের। এই ব্যস্ততা, কর্মাচাঞ্চল্য ছাড়িয়ে এক লাফে চোখ চলে যায় ৪৫ মিটার উচু স্মৃতিসৌধের চুড়ায়। ৫৩, ৫৪, ৫৮, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসের স্মরণীয় এই সাতটি বছরের স্মরণে ৭টি স্তম্ভ নিয়ে এই স্মৃতির মিনার। এখানে এলেই বিজয়ের আনন্দে মনটা ভরে যায়। ৮৪ একর জায়গা নিয়ে এর বিশাল বিস্তৃতি। তার ওপর চারপাশ জুড়ে আছে ২৪ একর জায়গা জুড়ে ‍বৃক্ষবলয়। মিনারের দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে একটি ফলক, যার মধ্যে লেখা বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা, এ যত মূল্য সেকি ধারার ধলায় হবে হারা/স্বর্গ কি হবে না কেনা/ বিশ্বের ভান্ডারী শুধিবে না এত ঋণ। সত্যিই তো, এ ঋণ আমরা এগুলো শুধবো কিভাবে? এই স্মৃতিসৌধ কেন বানানো হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ধোয়ামোছায় ব্যস্ত মজিদ বললেন, ৭১ এর গন্ডগোলর লাইগা। যাই হোক, ঘোলা পানির উপর ফুটে থাকা লাল পদ্ম দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম মিনারে। এর উপর বসা নিষেধ, জুতা নিয়ে ওঠা নিষেধ, মিনারের গায়ে লেখা নিষেধ। কিন্তু সবই চলছে। বেরিয়ে গিয়ে রাস্তা পার হলেই পর্যটনের ফুডশপ। ইচ্ছে ছিলো নাস্তাটা সেরে নেয়ার। কিন্তু পকেটের সঙ্গে দামের ফারাক দেখে ইচ্ছেটা মাটি হয়ে গেলো। আবার বাসে চড়ে গাবতলী। আরিচা রোড দিয়ে আসার সময় মনে হলো, এই রাস্তা দিয়েই তো মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ঢাকা আক্রমনের জন্য যাচ্ছিল। তখন তাদের যে আনন্দ হচ্ছিল, মনে হচ্ছে আমারও আজ সেই আনন্দ।

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ

গাবতলী নেমে মানিকগঞ্জ হোটেলে নাস্তা সেরে গেলাম মিরপুরের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। তালগাছে ঘেরা লাল ইটের চারটি মিনারের মাঝে স্মৃতিফলক। এখানেও চলছে ধোয়ামোছার কাজ। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে রাজাকারদের সহায়তার পাকবাহিনী হত্যা করে এদেশের অমূল্য সন্তানদের। এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম লালকুঠিতে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগারে। গেটে তালা ঝুলছে, খোলা হয়না অনেকদিন। দেশের বিশিষ্ট লেখকদের দান করা অজস্র ভালো বই নাকি একজন সংগঠকদের বাসায় বস্তাবন্ধী হয়ে পড়ে আছে।

আবার চড়লাম রিকশায়, গন্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। জাদুঘরের নাম বলো রিকশাঅলাকে চেনাতে পারলাম না, বলতে হলো ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর। বুধবারে এটা বন্ধ থাকে। অন্যান্য দিন ১০টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত খোলা। ৩ বছর বয়স পর্যন্ত বিনা টিকিটে ঢোকা যায়। বাকিদের ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয়। সুন্দর ছিমছাম জাদুঘর। সামনে সিরামিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। ভেতরে অনেক তথ্যমূলক ছবি। ৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে ১২ টায় যে পাঠকক্ষে বসে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখেছিলেন সে কক্ষটিও আছে আগের মতোই, তবে সেখান কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। বাইরে থেকেই যা দেখার দেখে নিতে হয়। ১৫ আগষ্ট রাতে নিহতদের ছবি আছে নিচতলায়। উপরতলায় বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত দ্রবাদি আছে।

শহীদ মিনার

শহীদ মিনার

জাদুঘর থেকে গেলাম রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। বেড়িবাধের পাশে বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ। এখানে ৯১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রজন্ম ৭১ তৈরি করেছিল ছোট একটি স্মৃতিসৌধ। পরবর্তী ৯৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। কাজ শুরু হয় ৯৭ এর এপ্রিল মাসে। এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। বর্তমানে  এর যাতায়াত ব্যবস্থা খুব খারাপ। মোহাম্মদপুর বাসট্যান্ড থেকে ধুলাবালি সমৃদ্ধ দীর্ঘপথ পায়ে হেটে পৌছতে হয় এখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গেলাম। ঢুকতেই কলাভবনের সামনে অবস্থিত অপরাজেয় বাংলা। এটি এখন দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতীক হয়ে। অপরাজেয় বাংলা পার হয়ে মধুর ক্যান্টিনে গেলাম। মধুদার মূর্তি কালো কাপড়ে ঢাকা। এখানে হালকা খাওয়া দাওয়া করে টিএসসিতে গেলাম। বাংলা একাডেমীর দেয়ালে সিরামিক দিয়ে আকা আছে ৫২ থেকে ৭১ এর সংগ্রামী দিনের চিত্রমালা। ড্যাসের পেছনে ২৫ মার্চ ৮৮ তে শামীম শিকদারের করা ভাষ্কর্য স্পোপার্জিত স্বাধীনতা পার হয়ে সোজা জাতীয় জাদুঘর। বৃহস্পতি ও শুক্রবার এটা বন্ধ থাকে। খোলা থাকে শনি থেকে বুধবার। শীতকালীন সময়সূচি সকাল ৯.৩০ থেকে বিকেল সাড়ে ৪ টা আর গ্রীষ্মকালীন সময়সুছি সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে বিকেল সোয়া ৫ টা পর্যন্ত। এখানেও ৩ বছর বয়সীরা বিনা পয়সায় ঢুকতে পারে। যাহোক ২০ টাকার টিকিট কিনে ঢুকে পরলাম শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে। এর তিনতলায় আছে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহৃত দ্রব্য আগ্নেয়াস্ত্র, লাটিসোটা থেকে শুরু করে পাকবাহীনির নিপীড়ন পর্যন্ত সবই আছে এ জাদুঘরে। চিত্রকলার গ্যালারিতেও অধিকাংশ চিত্রকর্মই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। আবার রিকশা, এবারের গন্তব্য সেগুন বাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। রিকশা থেকেই দেখলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেখে কে বলবে ৭১এর ৭ মার্চ এখানেই বয়ে গিয়েচির আগুনের বন্যা।

স্মৃতি সৌধ

স্মৃতি সৌধ

এই পার্কে উপস্থিত লাখো মানুষ হয়ে গিয়েছিল জ্বলন্ত আগুন, আগুনে পুড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি শোষণ। সে আগুনেরই ক্ষুদ্র রূপ এখন জ্বলছে শিখা চিরন্তন হয়ে। রিকশায় বসেই চোখে পড়ল অশ্লীল একটি ইংরেজী ছবির পোষ্টার। চলছে গুলিস্থান সিনেমা হলে। এই সিনেমা হলটি নাকি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের। ধরণী দ্বিধা হও, এ লজ্জা কোথায রাখি।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রোববার ছাড়া বাকি সবদিনই সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটা। টিকিট ২০ টাকা। এখানে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু স্মারক, ছবি, পোষ্টার ও পেপারকাটিং আছে। আছে মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহৃত দ্রবাদি। সারাদিন এখানে মুক্তিযুদ্ধের গান বাজে, টিভিতে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্টরি। প্রাঙ্গণে আছে ক্যাফে, ক্যাফে থিয়েটার, লাইব্রেরি, সেমিনার কক্ষ ও জ্বলন্ত শিখা। আটজন ট্রাস্টি্র উদ্যোগে সেগুনবাগিচার সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত। এরপর গেলাম রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। ঢুকতে হলো না, রাস্তা থেকেই বেশ দেখতে পেলাম মাথা উচু করে দাঁড়িযে আছে স্মৃতির মিনার। ততোক্ষনে শীতের সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাসায় ফিরছি, বুকপেটে তখনো সাভার স্মৃতিসৌধের ছবি সম্বলিত একটি পঞ্চাশ টাকার নোট। মুক্তিযুদ্বের সবকিছুই সগর্বে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। থাকবে নাইবা কেনো। এই তো আমাদের সর্বশেষ্ট অহংকার। আমরা রক্তের দামে স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে পেরেছি।

ছবিঃ আফতাব আহমেদের ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ বই থেকে নেয়া হয়েছে